Connect with us

Book Review

আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য

বইয়ের নাম- আমি সিরাজুল আলম খান

অনুলেখক – শামসুদ্দিন পেয়ারা

প্রকাশক-মাওলা ব্রার্দাস

প্রথম প্রকাশ-১৯ মার্চ,২০১৯

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী ইতিহাস সম্পর্কে যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে জনাব সিরাজুল আলম খান – এই নামটি মোটেও অপরিচিত নয়।

 

অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নেপথ্যে থাকা, রাজনৈতিক অঙ্গনে রহস্য পুরুষ, প্রচার বিমুখ ও ‘দাদা’ নামে পরিচিত এ মানুষটি সাম্প্রতিক সময়ে, – ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ নামে একটি বই লিখেছেন।

 

বইটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী জনাব তোফায়েল আহমেদ সাহেব বইটির  বক্তব্য  সম্পর্কে নিজের আপত্তির কথা জানায় এবং সে আপত্তি বা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

 

বইটির মূল প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান মাওলা ব্রাদার্স থেকে সংগ্রহ করতে না পারলেও ‘বিকল্প উপায়ে’ নীলক্ষেত থেকে বইটি সংগ্রহ করে ব্যপক কৌতূহল নিয়ে বইটি পড়া শেষ করি।

 

জনাব সিরাজুল আলম খান বইটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহ এতে সন্নিবেশিত করেছেন।স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্যে থাকা অল্প কয়েকজনের সাথে জনাব সিরাজুল আলম খানকেও ইতিহাসে স্থান দিতে হবে।

 

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ইতিহাসের বর্ননার সিংহভাগই জুড়েই ছিল ‘নিউক্লিয়াসের’ কথা।১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আযাদ এই চারজনকে নিয়ে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস। ( দুই বছর পর আযাদ নিউক্লিয়াস থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়,যার ফলে প্রথম তিনজনই নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিতি পায়)।নিউক্লিয়াসের লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ১০ বছরের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান  তথা মাতৃভূমিকে কে স্বাধীন করা।

 

জনাব সিরাজুল আলম খান কে নিউক্লিয়াস গঠন ও মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সমকালীন বিশ্বের যেসব ঘটনা প্রবাহ উদ্বুদ্ধ করেছে সেসব হল, আলজেরিয়ার মুক্তির সংগ্রাম,কিউবার বিপ্লবী আন্দোলন,ভিয়েতনামে মার্কিন বিরোধী লড়াই,ইন্দোনেশিয়ায় মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন।

 

নিউক্লিয়াস ছিল অত্যন্ত গোপনীয় একটি সংগঠন যা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গড়ে উঠলেও নিউক্লিয়াসের সদস্য ব্যতিত এটার অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউই জানতো না।এই গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যে নিউক্লিয়াস কর্মী নতুন কোন কর্মীকে নিউক্লিয়াসে ‘ রিক্রুট’ করতেন তিনি ব্যতিত অপর কোন নিউক্লিয়াস সদস্য ও এই নতুন কর্মী সম্পর্কে জানতেন না।তাদের গোপনীয়তার বিষয়টি এতোটাই কড়াকড়ি ছিল যে, তৎকালীন ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতা,আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ এমনকি খোদ বঙ্গবন্ধু ও প্রাথমিক অবস্থায় নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না।

 

৬৬ – র ছয় দফা,আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-র গনঅভ্যুত্থান,৭০-র সাধারণ নির্বাচন,৭১-র উত্তাল মার্চে পতাকা উত্তোলন, ‘ জয় বাংলা ‘ স্লোগানের প্রবর্তন,বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের বক্তৃতায়,”এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবাবের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” তথা স্বাধীনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি করণে নিউক্লিয়াসের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূর প্রসারী।

 

১৯৬৬-৬৭ সাল থেকেই নিউক্লিয়াস  তৎকালীন জাতীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে স্বাধীনতার বিষয়টিকে ” রাজনীতিকীকরণের” উদ্দেশ্যে যোগাযোগ করতে থাকেন।সেই ধারাবাহিকতায় আবু হোসেন সরকার,হামিদুল হক চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মাওলানা ফরীদ আহমদ,আতাউর রহমান খান,অলি আহাদ,মশিউর  রহমান যাদু মিয়া,মাহমুদ আলী, এটিএম তোহা,রফিকুল হক প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু তাঁরা কেউই স্বাধীনতার মতন এই ব্যপক তাৎপর্যবহ বিষয়টিকে নিজেদের চিন্তায় ধারণ করতে পারেননি।তাঁরা তখন  কোন সহযোগিতা তো করেননি বরং কেউ কেউ স্বাধীনতার এই চিন্তাটিকে আকাশ কুসুম কল্পনা হিসেবে দেশদ্রোহীতার শামিল বলে সতর্ক করেছেন।

 

সিরাজুল আলম খান তথা নিউক্লিয়াস স্বাধীনতার এই বিষয়টি নিয়ে সর্বশেষ  যান মজলুম জননেতা জনাব মাওলানা ভাসানীর কাছে। নিউক্লিয়াসের এই স্বাধীনতার কথা শুনে তখন  মাওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল,” আমি তো আর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হতে পারবো না। আর আমার সাথে যারা আছে তারা তো কমিউনিস্ট।কমিউনিস্টরা তো স্বাধীনতা চায় না,কমিউনিজম কায়েম করতে চায়।এই নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার মিলে না।আর যেসব নেতা আছে তাদের রাজনীতি হল মন্ত্রী হওয়ার জন্য। একমাত্র শেখ মুজিবের ই বুকের পাটা আছে।তাকে তোমরা সঙ্গে পাবে”।

 

মাওলানা ভাসানীর এ বক্তব্যের পর থেকেই নিউক্লিয়াস স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে এবং বঙ্গবন্ধুর সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে।

 

সিরাজুল আলম খানের ভাষ্যমতে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী জনাব বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন নিউক্লিয়াসের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী।

 

স্বাধীনতার পর সরকার ও রাষ্ট্র গঠন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের সাথে একটা রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়( ব্যক্তিগত সম্পর্ক আগের মতনই ছিল)।সিরাজুল আলমরা চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার ও রাষ্টের উর্ধ্বে থাকবেন এমনকি প্রয়োজনে তিনি রাজধানীর বাহিরে কোথাও অবস্থান করবেন।এছাড়াও বাকশাল সহ আরো বহু বিষয়ে তাদের মধ্যেকার রাজনৈতিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়।বঙ্গবন্ধু যখন শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে   যুবলীগ গঠন করলেন  তখন সিরাজুল আলম খানরা  জাসদ গঠন করেন।

 

এভাবে  নানা ঘটনার পরিক্রমায় ৭৫-র ১লা আগষ্ট সিরাজুল ইসলাম খানের সাথে  বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ দেখা হয়,  তখন বঙ্গবন্ধু  সিরাজুল আলম খানকে ভারতে চলে যেতে বলেন এবং সে মোতাবেক তিনি ভারতে চলে যান এবং সেখানেই তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে নিহত হবার সংবাদ পান।

 

৭৫-র ৭ ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের নেপথ্যেও ছিলেন  জাসদ ও সিরাজুল আলম খান।যখন তাদের এই বিপ্লব ব্যর্থ হল তখন অ্যাকশন কমিটিতে( মেজর জলিল,আসম আবদুর রব,কর্ণেল তাহের,হাসানুল হক ইনু ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া) পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আলোচনায় জনাব সিরাজুল আলম খান আরো ৬ মাস অপেক্ষা করার কথা বললেও তাঁর আগোচরেই তাকে না জানিয়ে কর্নেল তাহেররা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

প্রায় ৩০ বছর পর ২০০৫ সালে এসে সিরাজুল আলম খান শরীফ নুরুল আম্বিয়ার কাছে তাকে না জানিয়ে কর্ণেল তাহেরদের জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টার বিষয়টি জানতে পারেন।তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা।

তারিকুল আলম তাসিকুল
১৬/১০/২০১৯

Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.